সরকারি চাকরিজীবীদের মতো মাসে মাসে পেনশনের সরকারি টাকা পান না বেসরকারি স্কুল কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। চাকরি জীবন শেষে নিজ বেতনের ও সরকারি অংশ মিলিয়ে এককালীন পেনশন পান তারা। শেষ জীবনে ওই টাকা চিকিৎসায় ব্যয় করেন তারা। কারও সন্তানের বিয়ের খরচের অনুষঙ্গ এই অর্থ। কিন্তু চাকরি জীবন শেষে ৪-৫ বছরেও পেনশনের অর্থ পাচ্ছেন না শিক্ষকরা। জীবনের অন্তিম সময়ে পেনশন না পাওয়ায় দারিদ্র্যের গøানি সইতে হচ্ছে তাদের। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তের পরও বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা। তাদের প্রশ্ন, সারাজীবন ছাত্র মানুষ করে কি পেলাম! শিক্ষক জীবন শেষে দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে পরপারে পাড়ি জমাতে হচ্ছে। রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় অবসর সুবিধা বোর্ড। সকাল থেকেই এই বোর্ডে প্রবীণদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। তাদের মনে প্রশ্ন একটাইÑ কবে টাকা পাবেন! এই অর্থ না পেলে তো এলাকায় মুখ দেখানোও দায় হয়ে পড়েছে। সারাজীবনের সম্মানও অপমানের তীরে বিদ্ধ হচ্ছে। ভোলার চরফ্যাশন থেকে আসা এক প্রবীণ শিক্ষকের নাম আল মাহমুদ। তিনি বলেন, অবসরে টাকা পাব এই আশায় এলাকার মুদি দোকান থেকে বাকি খেয়ে চলেছি। এক বছরের বেশি সময় বাকি খাওয়ার কারণে দেনা হয়েছে লাখ টাকা। পরিশোধ না করায় নিজ এলাকায় বসবাস করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। উপায় না দেখে দুই এক মাস পর এখানে আসতে হচ্ছে! তিনি বলেন, ৫৯ বছরে চাকরি শেষ হয়। আগের সময় মানুষ বয়স কমিয়ে দিত। প্রকৃত পক্ষে ৫৯ হলেও শিক্ষকরা পেনশনে যাচ্ছেন ৬২-৬৩ বছরে। পেনশনের জন্য যদি আরও ৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়, তখন প্রকৃত বয়স হয় ৬৭-৬৮ বছর। ফলে, জীবিত থাকা অবস্থায় কম শিক্ষকের ভাগ্যেই নিজের জমানো এই অর্থ জুটছে। অবসরপ্রাপ্ত আরেক শিক্ষক রহমত আলী। একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন কবে টাকা পাবেন এই খবর জানতে। ঢাকায় আত্মীয়স্বজন না থাকায় উঠেছেন বোর্ডিংয়ে। তিনি বলছিলেন টাকার কারণে মেয়ের বিয়ে দিতে না পারার কথা। তিনি বলেন, অবসর বোর্ড থেকে বলছে আরও দুই বছর এই অর্থ পেতে সময় লাগবে। ততদিন বাঁচব কী না সেটাও জানি না। আমরা কি করব, কার কাছে যাব? তবে গত কয়েকদিন অবসর বোর্ডে প্রবীণ ব্যক্তির পাশাপাশি তরুণদের বড় অংশ দেখা যাচ্ছে। তারা কেন এসেছে তা নিয়ে একাধিক তরুণের সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু তাদের উত্তর সত্যিই হতাশার ও দুঃখের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে থাকেন এক শিক্ষার্থী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। গত দুই বছর ধরে এই ভবনে নিয়মিত আসা যাওয়া তার। প্রথম দিকে তার বাবাকে সঙ্গে নিয়েই এখানে আসতেন। গ্রাম থেকে মহসীন হলে উঠত তার বাবাও। কিন্তু গত ৬ মাস হলো তিনি আর বেঁচে নেই। বাবার মৃত্যুর পরও পেনশনের টাকা না পাওয়ায় এই শিক্ষার্থীর আক্ষেপেরও যেন শেষ নেই। হলের কাছে হওয়ায় এই ভবনে এখন প্রায়দিনই তিনি আসেন। অবসর বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষকের পেনশনের আবেদন জমা রয়েছে। এই বোর্ডের হাতে যে অর্থ তা দিয়ে এই জট ছাড়ানো কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ফলে, আবেদনের তারিখ দেখেই পেনশনের অর্থ দেওয়া হচ্ছে। তারা জানান, সরকার থেকে চার হাজার কোটি টাকা পাওয়া গেলে শিক্ষকদের কোনো ভোগান্তি থাকত না। কিন্তু বছরের পর বছর এই দাবি করা হলেও কোনো সরকারই শিক্ষকদের প্রতি সদয় হয়নি। আর আর্থিক অসঙ্গতি প্রতিষ্ঠানটিকে অনিয়ম-ঘুষ ও দুর্নীতির প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছিল। এর আগে অভিযোগ ছিল, প্রতি আবেদনে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য চলত অফিসটিতে। এই দপ্তরে বর্তমান সময়ে উপপরিচালক রয়েছেন দুইজন। এই দুই উপপরিচালক অন্তত ১৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত আছেন। অর্থাৎ তারা শিক্ষা ক্যাডার ও নিয়ম অনুযায়ী তাদের তিন বছর পর পর বদলি হওয়ার কথা। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির এলাকার শিক্ষা ক্যাডার মো. ইলিয়াস হোসাইনও এই অফিসে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। যারা এই অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে বহু দিনের অভিযোগ। অফিস সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর আর অফিসে আসেননি সাবেক শিক্ষক নেতা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ মোহাম্মদ সাদী। তিনি কোথায় আছেন কেউ জানে না। পরে পরিচালক আবু জাফর আহমেদকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে আইনমন্ত্রী সিটিজেন ব্যাংকের মালিক হয়েই শিক্ষকদের অর্থ তার ব্যাংকে কুক্ষিগত করেছেন। দুর্বল এই ব্যাংকে শিক্ষকদের আমানতের টাকা আর সেভাবে ফিরে আনাও সম্ভব হচ্ছে না। অবসর বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নতুন পর্ষদ না থাকায় নতুন কোনো আবেদন অনুমোদনের সুযোগ নেই। একমাত্র শিক্ষা সচিব নতুন আবেদন ছাড় করতে পারেন। সেটিও একটি সভার মাধ্যমে। কিন্তু গেল এক বছর এমন কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন পাওয়া শিক্ষকদের টাকাই এখনো দেওয়া হচ্ছে। অবসর বোর্ড বলছে, প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষকের টাকা পরিশোধ করতে প্রয়োজন ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিমাসে আবেদন ও টাকার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। মাসে গড়ে এই বোর্ডে ৯০০টির বেশি আবেদন জমা পড়ে এই বোর্ডে। অবসরের এই আবেদন নিষ্পত্তি করতে মাসে প্রয়োজন ১০৬ কোটি টাকা। শিক্ষকদের এমপিও কর্তন থেকে জমা পড়ে ৭০ কোটি টাকা। আর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে দেওয়া সিড মানি ও ব্যাংকে রাখা এফডিআরের লভ্যাংশ আসে ৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিমাসে ৩৩ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি থাকে। একইভাবে বছর হিসেবে দেখা যায়, প্রতিবছর আবেদন সংখ্যা ১০ হাজার ৮০০টি। এই আবেদন যারা করেছেন তাদের অর্থ পরিশোধ করতে প্রয়োজন ১২শ’ ৭২ কোটি টাকা। এমপিওর ৬ ভাগ টাকা থেকে আয় হয় ৮৪০ কোটি টাকা। বছরে এফডিআর থেকে লভ্যাংশ আসে ৩৬ কোটি টাকা। এরপরও প্রতিবছর ঘটতি থাকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক সরকারের দেওয়া ৫০০ কোটি টাকা ছাড়াও অল্প কিছু টাকা ছিল বোর্ডের। সেই অর্থ ও সিড মানির পরিমাণ বেড়ে এখন ৬৭০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর ব্যাংক থেকে সাড়ে সাত শতাংশ ইন্টারেস্ট পায় বোর্ড। এই আয় থেকে আগে ১০ শতাংশ উৎস কর এনবিআরকে দিতে হতো। কিন্তু এখন তা আরও ২০ শতাংশ বাড়িয়ে চাইছে এনবিআর। তবে দীর্ঘদিন এ বিশেষ সুপারিশ ও ঘুষ বাণিজ্যের কারণে অনেকে আবেদনের সঙ্গে সঙ্গেই অর্থ দেওয়া হতো। এর ফলে পেছনে থাকা আবেদনকারীরা আরও পিছিয়ে যেত। অবসর বোর্ড সূত্র বলছে, দুই ধাপে এই আবেদনের নিষ্পত্তি সম্ভব। সরকারের চার হাজার টাকা ভর্তুকি এবং প্রতি বাজেটে এই খাতে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া। চলতি বছরের মে মাসে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের অনুক‚লে ২০০০ কোটি টাকা (বন্ড হিসেবে) এ (অনুদান হিসেবে) বরাদ্দ দেয় অন্তবর্তী সরকার। তবে শর্তে বলা হয়েছে, ২০০০ কোটি টাকা লাভজনক সরকারি সিকিউরিটি/ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু সুদ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ‘চলতি তহবিলে’ জমা করে সেখান থেকে ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে। অবসর বোর্ডের সদস্য সচিব (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ বলেন, অর্থ না থাকার কারণে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। সেবাপ্রত্যাশী শিক্ষকদের একই কথা বলতে হচ্ছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া খুবই প্রয়োজন। দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, এই অর্থ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। শুধু বন্ডের সুদের অংশের অর্থ শিক্ষকদের মধ্যে বণ্টন করা হচ্ছে। সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসরের ছয় মাসের মধ্যে পেনশন সুবিধা পরিশোধে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে এই খাতের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই। এর ফলে আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।