দেশের প্রাথমিক শিক্ষাখাত যত দুর্বল সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ততটাই অকার্যকর, বিশেষজ্ঞদের মত এমনটি। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা খাতকে দুর্বল কিংবা অকার্যকর বলার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা খাতের সার্বিক চিত্রেই তা প্রতিফলিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের সাফল্য অন্যান্য খাতের তুলনায় অনেক বেশি। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণা তথ্যেও দেশের শিক্ষা খাতের উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত ১৬ বছরে প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে দেশ অনেক এগিয়েছে। শিক্ষা খাতের উন্নয়নের এ খবর নিঃসন্দেহে জাতির জন্য সুখের। বেসরকারি সংস্থা ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’ পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ-২০১৫’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময় বিদ্যালয়ে গমন-উপযোগী শিশুদের ভর্তির হার যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তের হারও। বেড়েছে শিক্ষার্থীদের শেখার যোগ্যতা। অন্যদিকে ঝরে পড়ার হার কমাসহ লৈঙ্গিক সমতাও বেড়েছে। প্রাথমিকে শিক্ষকদের যোগ্যতাও বেড়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য এসেছে মেয়েশিশুদের স্কুলমুখী করায়। মেয়ে-শিক্ষার্থীরা এখন ক্ষেত্রবিশেষ ছেলে-শিক্ষার্থীদের চেয়েও বেশি স্কুলগামী। এ জন্য নোবেলবিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অনেকেই বাংলাদেশের এ অর্জনের অকুণ্ঠ প্রশংসাও করেছিলেন। অনন্য এ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সম্মাননা। ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে অনেক এগিয়ে তা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাশাপাশি এও সত্য যে, দেশে শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কিছু দিন আগে ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল, এখনো প্রায় ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। একটি দেশের শিক্ষার ক্ষেত্রে এ তথ্য নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার এ চ্যালেঞ্জ মূলগতভাবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় শিক্ষার নানা সূচক ঊর্ধ্বমুখী বলা হয়েছে, তা নিয়ে হয়তো সংশয় নেই কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতাও যে এ খাতে বিদ্যমান, তা অস্বীকার করা যায় না। আমরা মনে করি, দেশে শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে, এ খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনের বিকল্প থাকতে পারে না।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি অর্জনে আমাদের নানা খাতে ব্যাপক সাফল্যের পাশাপাশি শিক্ষা খাতের সাম্প্রতিক এ চিত্রও হয়তো স্বস্তিদায়ক, কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিবেচনা করা এবং সে অনুযায়ী কার্যকর উদ্যোগ নেয়াও অপরিহার্য। কেননা, শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতা যেমন সরকারের কাঁধে বর্তায় তেমন এতে দেশের উন্নয়নও নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। গবেষণায় শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করে উল্লেখ করা হয়েছে, বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতাতেও শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে ভালো করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গণিতে ২০০০ সালে ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী কাঙ্খিত যোগ্যতা অর্জন করেছিল, সেখানে সাম্প্রতিক সময় অর্থাৎ ২০১৪ সালে তা ৬৯.২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এভাবে অন্য বিষয়গুলোতেও শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। এ ছাড়া ভর্তি হারও বেড়েছে তুলে ধরে আশা করা হয়েছে, ২০১৯ সালে শতভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। আবার শিক্ষকদের যোগ্যতা উন্নতির পাশাপাশি ১৬ বছরে নারী শিক্ষকের হার ৩২ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ হয়েছে বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। সার্বিক বিবেচনায় শিক্ষার এ চিত্র বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন বলা যেতেই পারে।
সর্বোপরি বলতে চাই, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, আর এ অধিকারটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। ফলে শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করাকে এখন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। আর এটা নিশ্চিতের পথের অন্তরায়গুলো যেমন- দারিদ্র্য, শিক্ষক ও অবকাঠামো সংকটসহ যাবতীয় সমস্যা দূর করার বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেয়া কর্তব্য। আবার শুধু শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিতের উদ্যোগ নিলেই চলবে না, মানসম্মত শিক্ষাও নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যদিকে শিক্ষাবাণিজ্য প্রতিহত করাসহ প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলাও অপরিহার্য।